শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৪ পূর্বাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার: বহুল আলোচিত দিরাই উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী হুমায়রা আক্তার মুন্নীর ঘাতক এহিয়াকে অবশেষে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। এ নিয়ে বাদির এজহারভূক্ত দুই আসামিকেই গ্রেফতার করেছে দিরাই থানা পুলিশ। আর এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিরাইসহ সর্বস্তরের সচেতন মানুষ পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। দিরাই থানা সূত্রে জানা যায়, বুধবার রাত পৌণে ১টার দিকে ঘাতক এহিয়াকে সিলেটের জালালাবাদ থানার মাসুক বাজার এলাকায় তার এক পরিচিত লোকের বাড়ি থেকে তাকে আটক করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আসামি এহিয়াকে গ্রেফতারের বিষয়টি জানানো হয়।
মামলার এজহার থেকে জানা যায়, গত ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরসভার (আনোয়ারপুর নয়াহাটি) মদনী মহল্লার বাদি নিহতের মামা আজিজুর রহমানের বাসার দোতলায় ঢুকে দিরাই উপজেলার করিমপুর ইউনিয়নের সাকিতপুর গ্রামের মোঃ জামাল মিয়া সরদারের ছেলে এহিয়া সরদার (২২) একই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের ছয়হারা নগদীপুর গ্রামের ইটালী প্রবাসি হিফজুর রহমানের মেয়ে ও দিরাই উউচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী হুমায়রা আক্তার মুন্নীকে (১৯) চাকু দিয়ে পর পর দুটি আঘাত করে। দ্বিতীয় আঘাতের সময় চাকু মুন্নীর শরীরে আটকে যায় এবং তার চিৎকার শুনে অন্য কক্ষে থাকা তার মা রাহেলা বেগম দৌড়ে এসে মেয়েকে রক্তাক্ত অবস্থায় পান। এ সময় ঘাতক এহিয়া রাহেলা বেগমকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায় বলেও এজহারে উল্লেখ করা হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে দিরাই হাসপাতালে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে সিলেটে প্রেরণ করেন। তবে অধিক রক্তক্ষরণের ফলে জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া নামক স্থানে যাওয়ার পর মুন্নী মারা যায় এবং তাকে পুনরায় দিরাই হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক মাতে মৃত ঘোষণা করে।
এদিকে মুন্নী মারা যাওয়ার পর মা রাহেলা বেগম বাদি হয়ে ঘাতক এহিয়া সরদার ও তাড়ল ইউনিয়নের তাড়ল গ্রামের আবুল কালাম চৌধুরীর ছেলে তানভীর আহমদ চৌধুরীসহ (২২) অজ্ঞাত ৩/৪ জনকে আসামী করে দিরাই থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১০, তারিখঃ ১৮/১২/২০১৭ ইংরেজি। মামলা দায়েরের পর ১৮ ডিসেম্বর দিরাই থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে একদল পুলিশ পৌর সদরের কলেজ রোডে অভিযান চালিয়ে এজহারভুক্ত আসামী তানভীর আহমদ চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত তানভীর আহমেদ চৌধুরী পৌর সদরের মাদানী মহল্লা আনোয়ারপুর নয়াহাটির বাসিন্দা আবুল কালাম চৌধুরীর ছেলে। তানভীর চৌধুরীর বাসভবনের পাশেই নিহত মুন্নী আক্তারের পরিবার বসবাস করতো।
ঘটনার পর রাতেই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলায়েত হোসেন লস্কর, দিরাই থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা কামালসহ পুলিশের একটিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াহিয়ার খুঁজে অভিযান চালায়। রবিবার দুপুরে সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার বরকত উল্লাহ খান ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাবিবুল্লা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দিরাই সার্কেল বেলায়েত হোসেন লস্কর ও সিনিয় সহকারি পুলিশ সুপার তাপস দাস। নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসিকে ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানে নিশ্চিত করার আশ্বস্ত করে পুলিশ সুপার বরকত উল্লা খান বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি মেয়েটির সাথে ছেলেটির প্রেমেরে সম্পর্ক ছিলো। নির্মম এ হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না, এ ব্যাপারে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করবো, ইতিমধ্যে ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে, এখন পুলিশের কাজ হচ্ছে ঘাতককে গ্রেফতার করা।
পুলিশ ও নিহতের পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, উপজেলার সাকিতপুর গ্রামের পিত্রালয় থেকে বছর চারেক পূর্বে বিতাড়িত ইয়াহিয়ার সাথে দীর্ঘদিন ধরেই স্কুল ছাত্রী মুন্নি আক্তারের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। কিছুদিন পূর্বে মুন্নির মা ছেলেটির বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জ র্যাব অফিসে একটি অভিযোগ করেছিলেন। র্যাব কার্যালয়ে ছেলেটিকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার একটি মুছলেকা নিয়ে তা সমাধান করে দেয়া হয়েছিলো। বিগত দুইমাস ভালই চলছিলো। ঘটনার তিনদিন আগে হঠাৎ মেয়েটির বাসায় গিয়ে ছেলেটি নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। নিজের শরীরের বিভিন্ন অংশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এবং তা ছবি তুলে নিজের ফেইসবুকে আপলোড করে।
নিহত মুন্নীর মা রাহেলা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, সামনের বছর (২০১৮ সালে) অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষা ভালো করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল আমার মেয়ে মুন্নী, তাই ভালোভাবে লেখাপড়া করানোর জন্য গ্রামের বাড়ি ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে আমি দিরাই আমার বাবার বাসায় থাকছি, কিন্তু বখাটে ইয়াহিয়া বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ায পথে এমনকি বাসার সামনে এসে আমার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলো, আমি ইতিপুর্বে আইন-শৃংখলা বাহিনীর নিকটও তার উত্ত্যক্ত করার বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছি, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না আমার মেয়ের।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে স্কুলছাত্রী হুমায়ারা আক্তার মুন্নীকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এহিয়া সরদারকে গ্রেফতার করেছে দিরাই থানা পুলিশ। ২০ ডিসেম্বর বুধবার রাত ১টায় সিলেটের জালালাবাদ এলাকার মাসুক বাজার থেকে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাবিবুল্লাহ নেতৃত্বে পুলিশের তিনটি দল তাকে গ্রেফতার করে। এর আগে মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে পুলিশ তার অবস্থান নিশ্চিত হয়। গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০টায় সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মোঃ বরকতুল্লাহ খান বলেন, ‘ঘটনার পাঁচ দিনের মধ্যে ঘাতক এহিয়াকে গ্রেফতার করা হল। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে এহিয়া প্রথমে ময়মনসিংহ, পরে ঢাকা ও সিলেটে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করেছে। এছাড়া সে সিলেটের মাজার এলাকায় কিছু সময় অবস্থান করে। তবে প্রযুক্তির মাধ্যমে তার গতিবিধির ওপর পুলিশ সবসময় নজরদারি করে। ঘাতক এহিয়া দিরাইয়ে একটি দোকানে সে সেলসম্যানের কাজ করতো। এ সুবাধে তার সঙ্গে মুন্নীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটি কিছুদিন বহাল ছিল। পরে মনোমালিন্য দেখা দিলে সে মুন্নীকে হত্যার হুমকি দেয়। ঘটনার দিন ইয়াহিয়া ও তার বন্ধুরা মুন্নীর বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে কথাবার্তার এক পর্যায়ে মুন্নীকে ছুরিকাঘাত করে।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে নিহত মুন্নীর শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠীরা দিরাইয়ে ঘাতকের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘ফাঁসি’ দাবি করে শোকমিছিল ও মানববন্ধন করেছে। এছাড়া ঘটনার পর থেকেই দিরাই ও সুনামগঞ্জে একাধিক মানববন্ধনে ঘাতকের গ্রেফতার ও ফাঁসির দাবি করা হয়।
বহুল আলোচিত সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে স্কুল ছাত্রী হুমায়রা আক্তার মুন্নী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিবাদ সমাবেশ ও শোকর্যালী অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় শুরুতেই নিহত মুন্নীর সহপাঠীদের অংশগ্রহণে শোকর্যালী বের করা হয়। র্যালীটি বিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে বের হয়ে পৌর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিদ্যালয় মাঠে মানববন্ধন কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়। নিহত মুন্নীর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল হক মিয়ার সভাপতিত্বে এবং সহকারি প্রধান শিক্ষক লালবাশী দাসের পরিচালনায় বক্তব্য রাখেন প্রধান শিক্ষক জাফর ইকবাল, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য মনোরঞ্জন চক্রবর্তি, সাজন সরদার, সাবেক প্রধান শিক্ষক শৈলেন্দ্র চন্দ্র দাস, শিক্ষক অনিন্ধিতা রায় চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা সরদার রুমী, উসমান গনি, আবু হেনা. জাকির হোসেন, নিখিল চন্দ্র দাস, সুদিপ, রুহেল সরদার, জিতু মিয়া, মানবাধিকার কর্মী নুরুল আজিজ চৌধুরী, প্রশান্ত সাগর দাস, সুজনের মাহবুব হোসেন, রুকনুজ্জামান জহুরী, সহপাঠীদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তমা আক্তার, তাহমিনা আক্তার চৌমুনি, নুরজাহান আক্তার মিতু, সুলতানা আক্তার কলি ও সায়মা অক্তার প্রমুখ।